• বিভাগঃ ঢাকা
  • জেলাঃ গোপালগঞ্জ
  • উপজেলাঃ গোপালগঞ্জ সদর
  • পৌরসভা/ইউনিয়নঃ উরফি

আখিজা বেগমের জন্ম উরফি ইউনিয়নের বারাইল গ্রামে। আখিজাদের সংসারে মা-বাবাসহ সদস্য সংখ্যা সাত জন। পাঁচ ভাই, দুই বোন। সন্তান হিসেবে ভাই-বোনদের মধ্যে আখিজা দ্বিতীয়, বোনদের মধ্যে প্রথম। সংসারে মাথা গোঁজার মত ছিল একটা ছনের কাঁচা ঘর। তখন সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। ছোট্ট শহর গোপালগঞ্জ। বাবা গোপালগঞ্জ শহরে ভাড়ায় রিক্সা চালক। রিক্সার মালিকের ভাড়া ছিল তখন দৈনিক পাঁচ টাকা। রিক্সা মালিকের ভাড়া মেটানোর পর বাকী আয় দিয়ে সংসার চালানো ছিল বাবার পক্ষে কঠিন। মা গৃহিনী। বাবার সঙ্গে মা-কেও সংসারের হাল ধরতে হয়। তাই মাকে অন্যের বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতে হয়।  

ছোট্ট আখিজা শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রাখে। আখিজার সমবয়সীরা স্কুলে যায়। সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে। অভাবের সংসার। নুন আনতে পানতা ফুরায়। তাই আখিজার স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়না। আখিজা তার বান্ধবীদের পানে চেয়ে চেয়ে দেখে, তার বুকের ভিতর গুমরে কেঁদে ওঠে না পাওয়ার বেদনা। কষ্টের নীলজল চোখের কোণে ছল ছল করে। হয়তো ভাবে, বাবার সংসারে প্রত্যাশা পূরণ নাহলেও একদিন ঠিক-ই স্বামী’র সংসারে পূরণ হবে। ভাবতে ভাবতে দিন যায়, রাত যায়। এভাবে তেরটি বসন্ত আখিজার জীবনে পার হয়ে যায়। এরই মাঝে একদিন আখিজার বিয়ের সম্বন্ধ আসে। হবু বরের বাড়ি বাগেরহাট জেলার তেরোখাদা থানার নৈলারচর গ্রামে। হবু বরের স্বাস্থ্য ভালো, সুঠাম দেহের অধিকারী। কৃষি জমি নাই। তাই পেশায় ভ্যান চালক। বাবার পছন্দ হয়েছে। কেননা বাবার পেশার সঙ্গে হবু জামাইয়ের মিল আছে। মায়ের অমত বাবার সিদ্ধান্তে উবে যায়। বিয়ে হয়। বরের সঙ্গে শ্বশুর বাড়ি যাত্রা। লাল বেনারশী আখিজার জোটেনা। এখানেও স্বপ্নভঙ্গ। কি আর করা। শ্বশুরবাড়িতেও সংসারের টানাটানি। অভাব যেন আখিজার পিঁছু ছাড়েনা। স্বামীকে নিয়ে আবার বাবার বাড়িতে প্রস্থান। স্বামীকে সবাই বলে ঘরজামাই। আখিজার আবেগে লাগে। অভাব আর লাঞ্ছনাকে সহ্য করে এগিয়ে যায় আখিজার সংসার। এরই মধ্যে সংসারে একে একে আসে তিন কন্যা আর এক পুত্র সন্তান। ওদিকে স্বামীর সেই সুঠামদেহ আর সুঠাম থাকেনা। ভ্যানের চাকা আর সংসারের চাকায় যেন পিষ্ট হতে থাকে আখিজাদের ভাগ্য। আখিজার স্বামী এরই মধ্যে হঠাৎ প্যারালাইজ্ড হয়ে পড়ে। সংসারে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। আখিজা চোখে সর্ষে ফুল দেখতে থাকে। কি করবে ভেবে পায়না। চোখের সামনে সংসার নামের অথৈ পাথার। এরই মধ্যে আখিজার বাবা মারা যায়। ভাইয়েরা সব আলাদা সংসারী। তাদেরই করুণ অবস্থা। আখিজা সাত-পাঁচ ভাবতে থাকে। একসময় সেও সিদ্ধান্ত নেয়, তার মায়ের পেশাটাই বেছে নেবে সে। তাই সেও অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেয়। দুইবেলা খাওয়া আর মাস গেলে এক হাজার টাকা। টাকার একটা অংশ ব্যয় হয় স্বামীর অসুখের চিকিৎসায়। এভাবে টানা-পোড়েনের মধ্য দিয়ে সংসার চলতে থাকে। বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে যায় আখিজার জীবনে। একদিন ঝিয়ের কাজ সেরে বাসায় এসে দেখে, প্যারালাইজ্ড স্বামীর নিথর দেহ পড়ে আছে বিছানায়। আখিজার জীবনটাই যেন দুঃখ দিয়ে গড়া। সুখ জিনিসটা কী, আখিজা তা উপলব্ধি করতে ভুলে গেছে। সংসারে মেয়েগুলো বেড়ে ওঠে। একে একে তিনটি মেয়েকেই বিয়ে দিয়ে দেয় আখিজা। ছেলেটা বিয়ে করে বউকে নিয়ে চলে যায় ঢাকায়। খোঁজ-খবর নেয়না। এখানেও আখিজার স্বপ্নভঙ্গ হয়। ছোট মেয়েটার নাম ঝুমুর। একটা পুত্র সন্তান জন্ম দিয়ে নিখোঁজ হয় তার স্বামী। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ। আখিজা কি করবে ভেবে পায়না। মাথা গোঁজার নিজস্ব কোন ঠাঁই নেই। এরই মাঝে সুখ নামের পাখিটার ছায়া দেখতে পায় আখিজা। এবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিান ঘোষণা দেন, ‘‘বাংলাদেশের একটি লোকও আর গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবেনা।’’ ঝিলিক দিয়ে ওঠে আখিজার চোখের কোণের হিমায়িত স্বপ্ন। তৃতীয় পর্যায়ে ২৬,২২৯ টি একক গৃহের মধ্যে আখিজাও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলাধীন ৭ নং উরফি ইউনিয়নের ৩২ নং মকিমপুর মানিকহার মৌজার এসএ ০১ নং খাস খতিয়ানের এসএ ৪২৬৯ নং দাগে (মধুপুর নামক প্রকল্পে) দুই শতাংশ জমিসহ একটা আধা-পাকা টিনের ঘর দলিলসহ পেয়ে যায়। আখিজা আবেগে কেঁদে ওঠে। এ যে কান্না নয়, স্বপ্নপূরণের যাত্রা। এতদিনে দুই শতাংশ জমিসহ নিজের একটা আধা-পাকা বাড়ির মালিক হল সে। আখিজা তার ছোট কন্যাকে নিয়ে উঠে যায় তার নিজের স্বপ্নের ঠিকানায়। শুরু হয় দিন বদলের পালা। আখিজার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ বছর। শরীরে আর মানায় না। ছোট মেয়ে ঝুমুর উরফি গ্রামে গড়ে উঠা একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ পেয়ে যায়। বেতনও ভালো। শুরুতেই সাত হাজার টাকা বেতন। সংসারে আখিজা, তার কন্যা ঝুমুর, আর ছোট্ট নাতি ইব্রাহীম। ইব্রাহীমকে আশ্রয়ণের পাশেই মধুপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেয় আখিজা। আখিজা এখন আর কাজ করেনা। নাতিকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আর আসা। পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়া। অভাব-অনটনের সংসারে এতদিন সে সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করতে পারেনি। তাই, আখিজার স্বপ্ন-‘‘ যতদিন বেঁচে আছি, বাকীটা সময় আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দেব। আর যার হাত ধরে স্বপ্নপূরণের যাত্রায় শামিল হয়েছি, সেই মহিয়সী নারী, মমতাময়ী মা, মানবতার মা-হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী-শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করে যাব। আল্লাহ যেন তাকে নেক হায়াত দান করেন এবং আমার মত লক্ষ লক্ষ লোকের স্বপ্নপূরণের বাতিঘর হয়ে থাকে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয়তু শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।’’