• বিভাগঃ ময়মনসিংহ
  • জেলাঃ নেত্রকোণা
  • উপজেলাঃ কলমাকান্দা
  • পৌরসভা/ইউনিয়নঃ বড়খাপন

একজন জয়নবের কথা....

বেলা তিনটার উপরে বাজে। 

নেত্রকোনা জেলা শহর থেকে কলমাকান্দা উপজেলা ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব। নেত্রকোনা-কলমাকান্দা হাইওয়ে থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্বে আশ্রায়ন প্রকল্প-তে ঠাঁই পেয়েছে জয়নব বেগম। চার সদস্যদের পরিবারের মাঝে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিই। অবশ্য অন্যান্যরা ঠুকঠাক উপার্জন করতে পারে। তবে তারা দুইজন প্রতিবন্ধী ও প্রাপ্ত বয়স্ক । আশ্রায়ন প্রকল্পে ঢুকতেই লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে কাছে  আসার সময় দৃষ্টিগোচর হলো ৬০/৬৫ বছরের এক বৃদ্ধা মহিলার। আমার দৃষ্টিটার পুরো তার দিকে কেন্দ্রিভূত হলো। শরীরের চামড়া বয়সের ভাড়ে কুচকে গেছে, গায়ের জোরও  প্রায় নিভু নিভু। কাছে এসেই একফালি দাঁতের স্মৃতিচিহ্ন থেকে বেরিয়ে এলো নিখাঁদ হাসির ডালপালা। ছবি তুলছি আর তার কথাবার্তা  শুনছি।

-বাবা আফনে কইত্তেন আইসেন? কতদিন ধইরা খুউব কষ্টে যাইতাছে দিন। ছেলেডা বাউয়্যা কামে গেছে।

-আমি আপনাদের ঘরের আর আপনাদের ছবি তুলতে আইসি। চাচী।

-শুধু কি ছবিই তুলভাইন? খাওন-টাওন কিছু আনসেন না। খুব  ক্ষীদা লাগসে? শইলডাতেও জ্বর। ঘরে যা খাওন আছিল সব ছেইডা(মেয়েটা) খাইয়া লাইসে। অহন কি করন?

আমি তার কথার কোন জবাব দিতে পারলাম না। কেবল শুনতে থাকলাম। 

আমার কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে জানলাম  জয়নবের জীবনযুদ্ধের গল্প। 

৩০/৩৫ বছর পূর্বে তিনি সংসার পেতে ছিলেন পাশের বিশাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিদ্দিক মিয়ার সাথে। বর্গা চাষী সিদ্দিকের কোন নিজস্ব জমি নেই। অন্যের ক্ষেতে কাজ আর চাষবাস করে দিন পার করতো তারা। বছর ঘুরতে না ঘুরতে জন্ম হলো কন্যা সন্তানের জননী হন তিনি। শুরুতে শিশু ফাতেমাকে স্বাভাবিক মনে হলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধরা পড়লো । কন্যাটি স্বাভাবিক মানুষের মতো না। শারিরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম। এভাবে আরো কয়েকটি সন্তানের জন্ম হলো-কিন্তু তাদের ২/৩ জনই জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো। এরপর একটা পুত্র সন্তানের জননী হলো-কিন্তু বিধাতার কি অমোঘ নিয়মে চলে পৃথিবী? সেই সন্তানটিও প্রতিবন্ধী।

প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে যুদ্ধ করে ঠিকে জয়নব হাল ছাড়েনি। একটা সময় স্বামীর পরিশ্রমে কিছুটা স্বচ্ছল হলেও কয়েক বছর পর স্বামীও  চলে যান। না ফেরার দেশে। এবার জয়নবের  সামনে আর কোন রাস্তা নেই। স্বামীর কিছু ধার দেনার জন্যে হারাতে হয় আপন বসত ভিটাটুকুও। একটা সময় তিন সন্তান নিয়ে -ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করে। সারাদিন এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে ঘুরে  যা সংগ্রহ হয় তা দিয়ে সবার পেট ঠিকমতো তৃপ্তির শ্বাস ফেলতে দেয়না।

সমাজের মানুষগুলোও কেমন জানি অসহায়কে লাত্থি মারে-আর সহায়কে নিয়ে অপচয়ের পসরা সাজায়। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত থেকে থেকে কোনমতে চলছিলো -তার পরিবার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ন প্রকল্পের আধাপাকা ঘর তাকে নতুন করে জীবনযুদ্ধে সাহস যোগােচ্ছে। একটি  বেসরকারি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা লোন নিয়ে। ছেলেটাকে গ্রামের হাটে কিছু খুচরো মালামাল কিনে দিয়েছেন। বয়স হয়েছে-তাই আর ভিক্ষা করার মতো শক্তিটাও নাই।

(কেঁদে...কেঁদে)........জানো বাবা...হাসিনা(মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) আমারে এ্যাই ঘর না দিলে , অহন সন্তানডিরে লইয়া কই থাকতাম।............কান্নার সুর আরো গভীর হয়। আমারও কোন শান্ত্বনা দেয়া ভাষা মনে আসেনা। কেবল শুনতে থাকি...জীবনযুদ্ধ-তে হারতে থাকা ষার্টোধ্ব মহিলার কথাগুলো-

’’হাসিনা মা তোমারে ধন্যবাদ। তুমি  এ্যাই ভিক্ষুকটার কথাও ভাব”

বৃদ্ধার কথা শোনে আমি যেনো কোন এক জগতে হারিয়ে যাই...। কান্নার সুর আর চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে তার শাড়ির আঁচল। নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষন। তারপর সন্ধ্যার আযানের ধ্বনিতে বাস্তবতায় ফিরে আসি।  একসময় বুঝতে পারি আমার ফেরার সময় হয়ে গেছে। বাড়িতে যেতে হবে। বাজার/সদাই কিনতে হবে।

.................................................................................................রিংকন মন্ডল রিংকু, উদ্যোক্তা, বড়খাপন ডিজিটাল সেন্টার