• বিভাগঃ চট্টগ্রাম
  • জেলাঃ চাঁদপুর
  • উপজেলাঃ চাঁদপুর সদর
  • পৌরসভা/ইউনিয়নঃ লক্ষীপুর মডেল

নামঃ প্রাণ গোপাল সরকার (৫০), বৃত্তি-ভিক্ষা

পিতাঃ চন্দ্র মোহন সরকার

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার

ঘর নং-২২ এর বাসিন্দা

 

তিন পুরুষের স্বপ্নের ভিটায় সংসার পেতেছেন অন্ধ প্রাণ গোপাল সরকার এবং জন্ম কানা সাবিত্রি রানী সরকার দম্পতি। প্রাণ গোপালের তিন পুরুষের ভিটে মাটির স্বপ্ন পূরণ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০নং লক্ষীপুর মডেল ইউনিয়নে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার ২২ নং ঘরের বাসিন্দা তারা।

 

চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার নায়েরগাঁও ইউনিয়নের তিতার কান্দি গ্রামে এক কৃষকের জীর্ণ কুটিরে থাকতেন প্রাণ গোপালের দাদা। নিজেদের কোন জমি নেই, ঘরে থাকার জায়গা নেই তাই লায়েক হতেই জীবিকার তাগিদে ঘর ছাড়েন প্রাণ গোপালের বাবা চন্দ্র মোহন সরকার। চলে আসেন চাঁদপুর শহরে, অচেনা শহরে ঘুরতে ঘুরতে জওয়ান চন্দ্র মোহন কাজ পেলেন পালবাজার মাছের আড়তে। দিনে কাজ করে রাতে আড়তেই ঘুমাতেন। যখন বিয়ে করলেন তখন মনিবের দয়া হলে চাঁদপুর শহরের জামতলা নিশি বিল্ডিংএলাকায় একটা ছাপড়া ঘর তোলার মৌখিক অনুমতি পেলেন চন্দ্র মোহন। শর্ত হলো চন্দ্র মোহন যখন আড়তে কাজ করবেন তার স্ত্রী মনিবের বাসার কাজে সহযোগিতা করবেন। ছেলের ঘর হয়েছে শুনে প্রাণ গোপালের দাদা দাদি ও চলে আসেন গ্রাম ছেড়ে।  সে ঘরেই জন্ম হয় প্রাণ গোপালের।  ১ বোন ও ৩ ভাইয়েরমধ্যে প্রাণ গোপাল ৩য়। সবাইকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। ছোটবেলা থেকেই উচ্ছল প্রাণ গোপাল যখন ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকেই তার ১টি চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে শুরু করে। দরিদ্র চন্দ্র মোহন একা হাতে এতো বড় সংসারের খরচ সামলে প্রাণ গোপালের নিয়মিত চিকিৎসা করানো অসাধ্য হয়ে পড়লো। এভাবে চলতে চলতে এক সময় ২য় চোখটিও ঝাপসা হতে শুরু করলো। এবার আর সইতে পারলেননা চন্দ্র মোহন। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা ধার করে বিভিন্ন মনিবের বাড়ি ধরনা দিয়ে সামান্য টাকায়ই কোনরকমে চললো প্রাণ গোপালের চোখের চিকিৎসা। চাঁদপুর , চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের সম্ভাব্য সকল স্থানেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করলেন চন্দ্র মোহন। সবাই ঔষধ দিচ্ছে সাধ্য মতো সেই ঔষধ কিনার চেষ্টাও করছেন চন্দ্র মোহন কিন্তু উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। খবর পেয়ে এগিয়ে এলেন ভারত বসবাসকারী চন্দ্র মোহনের চাচা। তিনি প্রাণ গোপালের চোখের উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রাণ গোপালকে কলকাতায় নিয়ে গেলেন জওহরলাল নেহেরু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বড় ডাক্তারের কাছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার জনালেন অনেক দেরী হয়ে গেছে  ততোদিনে প্রাণ গোপালের ২টি চোখেরই কর্ণিয়া নষ্ট হয়ে গেছে।  শেষ হয়ে গেছে চোখের আলো ফিরে আসার সব সুযোগ। চিরতরে আশা ভংগ হলো এই সুন্দর পৃথিবী দেখার। ফিরে এলেন বাবার কাছে। বন্ধ হয়ে গেলো লেখাপড়া। বড় বোনের বিয়ে হলো। সংসারে ৪ সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মা আর স্ত্রী নিয়ে একাহাতে রোজগার করতে করতে অসুস্থ্য হয়ে গেলেন চন্দ্র মোহন সরকার। অকালেই পরপারে চলে গেলেন সবাইকে ছেড়ে। চন্দ্র মোহনের অকাল মৃত্যুতে সংসারের ভার এসে পড়ে ঘরের বড় ছেলে প্রাণ গোপালের বড়ভাই ননী গোপালের ওপর। ইতিমধ্যে মনিবের পরিবার হতে তাদের জানানো হলো নতুন ঘর করার জন্য তাদের জমির প্রয়োজন তাই তাদের জমি খালি করে দিতে হবে। নিরুপায়ন নী গোপাল বৃদ্ধ দাদা, দাদী, মা, প্রাণ গোপাল ও তাদের ছোট ভাইকে নিয়ে শহরের পালপাড়ায় ভাড়া বাসায় উঠলেন। তরুন ননী গোপাল বই ছেড়েবাবার রেখে যাওয়া পুরোনো কজে দৈনিক হাজিরায় যোগ দিলেন। পরিবারের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। দিন রাত পরিশ্রম করে পরিবারের ভরন পোষণ, ঘর ভাড়া, দাদা দাদীর ঔষধের জোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন ননী গোপাল। কিছুদিন পর দাদা তারপর দাদী মৃত্যু বরণ করলেন। নিজে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি, প্রাণ গোপাল তো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তাই আদরের ছোট ভাইকে নিয়েই তার স্বপ্ন। ছোট ভাইয়ের মাঝেই নিজের ভবিষ্যত সুখের ছবি আঁকলেন। পরিবারের চাপ বেড়ে যাওয়ার ভয়ে নিজে বিয়ে করার চিন্তা বাদ দিলেন। কিন্তু সে আসাও ভংগ হলো তার। ছোট ভাই ঘরের কাউকে না জানিয়ে অল্প বয়সেই বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা বাসায় চলে গেলেন। এই ঘটনায় মনের কষ্টে, দুঃখে ননী গোপাল অন্ধ প্রাণ গোপাল আর তার বৃদ্ধ মাকে ভাড়া বাসায় রেখে কাউকে না বলে ঘরবাড়ী ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। চোখের সামনে সন্তানদের ভাংগন দেখলেন প্রাণ গোপালের মা। সারাদিন বুক চাপা কান্না নিয়ে মনে পাথর বেঁধে দিন কাটান প্রাণ গোপালের মা। এবার নিরুপায় হয়ে ঘর থেকে বের হলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধি প্রাণ গোপাল। কাজ পাবে কোথায়? সে তো চোখে দেখেনা। বাধ্য হয়েই শুরু করলেন ভিক্ষা বৃত্তি। ঘরে অসুস্থ্য মা, মাস শেষে ঘর ভাড়ার তাগিদ, তিন বেলা খাবারের স্বপ্ন, নিজের প্রতিবন্ধকতা সব মিলিয়ে পর্যুদস্ত প্রাণ গোপাল। নিজের ওপর আস্থা নিয়ে চোখেনা দেখলেও প্রখর অনুমান শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিয়তির সাথে মিতালি গড়েন হার না মানা প্রাণ গোপাল। একাই রাস্তায় নামেন ভিক্ষা করতে। দিন শেষে খাবার এনে তুলে দেন মায়ের মুখে। যথক্ষণ ঘরে থাকেন ততক্ষণ মাকে তারকাজে সহযোগিতা করেন। এভাবেই চলছিল জীবন। একটা সময় প্রতিকূলতার সাথে অভ্যস্থ হয়েযান প্রাণ গোপাল। সবশেষে একদিন প্রাণ গোপালকে একা ছেড়ে মা ও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। নিঃসঙ্গ প্রাণ গোপালের আর্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস যেন ভারী হয়ে আসে। এলাকার মানুষের সহযোগিতায় মায়ের শেষকৃত্য শেষ করেন অন্ধ প্রাণ গোপাল।

জীবনের সকল প্রয়োজন যেন তুচ্ছ হয়ে যায় তার কাছে। সারাদিন খেয়ে না খেয়ে পরে থাকেন তার অন্ধকার ভাড়া ঘরে। শোক কাটিয়ে পেটের তাগিদে আবার রাস্তায় নামেন প্রাণ গোপাল। এখন নিজের খেয়াল নিজেকেই রাখতে হয়। নিজের খাবার নিজেকেই রাঁধতে হয়, নিরুপায় অন্ধ প্রাণ গোপালকে। একদিন মাছ ঘাটে ভিক্ষা করতে গিয়ে ভোলা থেকে মাছ বিক্রি করতে আসা জেলেদের কাছে জানতে পারলেন তার বড়ভাই ননী গোপাল ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলায় একটা মাছের আড়তে কাজ করেন। তাদের কাছেই তার অবস্থা জানিয়ে খবর পাঠালেন বড় ভাইয়ের কাছে সেই সাথে মায়ের মৃত্যুর খবরও গেলো। ননী গোপাল বিচলিত হয়ে ফিরে এলেন চাঁদপুরে। প্রাণ গোপালের খোঁজ খবর নিলেন এবং প্রতিমাসে ঘর ভাড়ার টাকা লোক মারফত পাঠিয়ে দিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। কিছুটা মনের জোর বাড়লো প্রাণ গোপালের। তার কষ্টের কথা চিন্তা করে স্থানীয় প্রতি বেশিরা প্রাণ গোপালের বিয়ের উদ্যোগ নিলেন। বড় ভাই ননী গোপালের অনুমতি নিয়ে এলাকার লোকজনের সহযোগিতায় পাত্রি ঠিক হলো কচুয়া উপজেলার বাবা হারা জন্মকানা তরুণী সাবিত্রি রানী সরকার। সাবিত্রি তখন চাঁদপুর শহরের উকিল পাড়ায় বসবাসরত তার মামার ঘরে আশ্রিতা। বয়সে তরুন চটপটে সাবিত্রি পুরান বাজার স্টার আল-কায়েদ জুটমিলে দৈনিক ৪০ টাকা হাজিরায় শ্রমিকের কাজ করতেন। অন্ধ পাত্র আর কানা পাত্রী নিয়ে আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের নানান প্রতিবন্ধকতার পর অবশেষে প্রজাপতির ডানা উড়লো। প্রাণ গোপালের নিঃস্ব জীবনের অবসান ঘটলো; কিন্তু তার মনে খুব ভয়, সে তো চোখে দেখেনা যদি তার বউ চলে যায়? তাই সে বউকে ঘিরে তার স্বপ্ন সাজালো। বউয়ের পূর্বের চাকরি বাদ দিয়ে এখন নিজের সাথেই স্বামী স্ত্রী মিলে ভিক্ষা করতে বের হলো। সারাদিন এক সাথে ভিক্ষা করে আর মিষ্টি মধুর আলাপচারিতায় দিন কাটে তাদের। প্রাণ গোপাল তো চোখে দেখেনা কিন্তু সাবিত্রিতার ১ চোখে দেখা পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য্য কথার জালে ফুটিয়ে তোলে প্রাণ গোপালের কানে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সাবিত্রির কথা শুনে প্রাণ গোপাল। দেখতে দেখতে তাদের ঘরে মেয়ে অনিতা (৯) এবং ছেলে অনন্তের (৫) আগমন ঘটে। দায়িত্ব বেড়ে যায় প্রাণ গোপালের। জীবনের সাপ লুডুতে পোড় খাওয়া প্রাণ গোপালের সাধ্যের মধ্যে এখন সুখের সংসার কিন্তু ভাড়া ঘর যেন পিছু ছাড়ছেনা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। যার দুবেলা খাবার জোটাতে রক্ত পানি হয় তার জমির মালিক হবার স্বপ্নতো সুদূর আকাশ কুসুম।

 জীবনযুদ্ধে এগিয়ে চলা প্রাণ গোপালের কাছে স্বপ্নপূরণের পয়গাম নিয়ে আসে মুজিববর্ষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে জমির মালিকানাসহ ঘর প্রদানের সংবাদ পৌঁছে যায় প্রাণ গোপালের কাছেও। সাবিত্রিকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধেন প্রাণ গোপাল। লোক মুখে শুনে শুনে সম্ভাব্য সকল দরজায় কড়া নাড়েন সাবিত্রি ও প্রাণ গোপাল। অবশেষে প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন প্রাণ গোপাল। নানান যাচাই বাছাই শেষে চাঁদপুর সদর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অন্ধ প্রাণ গোপাল আর জন্ম কানা সাবিত্রি রাণী সরকারে হাতে পৌঁছে দেয়া হলো তার স্বপ্নের ঠিকানা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার ২২ নং বাড়ীটি। ২ সন্তান ও প্রিয়তাম স্ত্রী সাবিত্রিকে নিয়ে প্রাণ গোপাল বেঁধেছেন সুখের ঠিকানা। পেয়েছেন নিজের একটা ঘর, নিজের ঠিকানা। ঘুঁচে গেছে ৩ পুরুষের ভাড়াবাড়ীর গ্লানি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ২ শতাংশ জমির বর্তমান আনুমানিক মূল্য ঘর সহ প্রায় ০৫(পাঁচ) লাখ টাকাসহ অন্যান্য সম্পদের পরিমান প্রায় ৬ (ছয়) লক্ষ টাকা  । 

বদলে গেল তাদের জীবন। জীবনের খেলা ঘরে ডুবতে ডুবতেও ভেষে ওঠা তরীতে সব হারিয়ে জীবন সায়াহ্নে স্রষ্ঠা যেন দুহাত ভরে দিয়েছেন প্রাণ গোপালকে। নিজের আর্থিক কষ্ট থাকলেও বড় মেয়ে অনিতা (৯) কে ভর্তি করেছেন স্কুলে একদিন সে লেখাপড়া করে মানুষ হবেন। বাসা ভাড়ার দায় নেই। দানের টাকায় নিজ খরচে নিজের ঘরের সামনে টিন দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়েছেন প্রাণ গোপাল। প্রাণ গোপালের সংসার হয়েছে এখন ঘরও হলো এই খবর পেয়ে তার কাছে ফিরে এসেছেন তার অকৃতদার বড় ভাই ননী গোপালও। শেষ জীবনটা প্রাণ গোপালের পরিবারেই থাকতে চান অসুস্থ্য ননি গোপাল। প্রাণ গোপালের সন্তানরাই এখন তারও সন্তানের মতো। এখন আর আগের মতো দুজনে মিলে সারাদিন ভিক্ষা করতে হয়না তাদের মাস শেষে ননী গোপাল কিছু খরচ দেন কিছু খরচ আসে একমাত্র বোনের পরিবার থেকেও। সব মিলিয়ে বদলে যাওয়া জীবনে যেন ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন তারা। শুরুটা কষ্টের হলেও শেষ জীবনটা ভালই যাবে প্রাণ গোপালের এ তুষ্টিতেই তিনি কৃতজ্ঞ মাননীয় প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি।

ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।