প্রকাশের তারিখ : ২২ এপ্রিল ২০২৩

তিনটি ঘরের প্রতিটিতে রয়েছে বিদ্যুৎ-সংযোগ। কয়েকটি ঘর মিলিয়ে বসানো হয়েছে সুপেয় পানির গভীর নলকূপ। পাম্প দিয়ে বড় বড় ট্যাংকে পানি জমা রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি ঘরের ভেতর রয়েছে রান্নাঘর শৌচাগার। এসব ঘরের চারদিকে সবজি বাগানসহ গাছগাছালি লাগিয়েছেন অনেকে। সব মিলিয়ে গোছানো পরিপাটি রূপ পেয়েছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে নির্মিত প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো।এরই মধ্যে প্রকল্পের ৬৭৪টি ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে গৃহহীন দরিদ্র মানুষজনকে। সীমান্তঘেঁষা প্রত্যন্ত জাম্বুরাছড়া গ্রামের ত্রিপুরা পল্লির পঞ্চাশোর্ধ্ব উপেন্দ্র দেববর্মা এমন একটি ঘর পেয়ে উচ্ছ্বসিত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে আমরা যে মাটির ঘরো থাকতাম, ইটাত খুব কষ্ট হইত। রইদ, মেঘ, তুফান আর শীতোর মইধ্যে ঘরে থাকা যাইত না। মেঘর (বর্ষায়) সময় টিন কানা (ছিদ্র) হইয়া পানি পড়ত। কারেন্ট আছিল না ঘরো, অখন প্রধানমন্ত্রী আমারে একটা নতুন ঘর দিছেন। ঘরর মালিক বানাইয়া দিছেন। অখন ঘরর মধ্যে পাকঘর (রান্নাঘর), বাথরুম, কারেন্ট, পানি সব আছে। আমি কোনো সময় ভাবছি না, এত সুন্দর ঘর বানাইতে পারমু।উপেন্দ্র দেববর্মার মতো ত্রিপুরা পল্লির ২৪টি পরিবার পেয়েছে ঘর। বিভিন্ন জায়গায় কষ্ট করে থাকা দরিদ্র এসব মানুষের জীবনে এসব ঘর দিয়েছে মাথাগোঁজার শান্তি। সেখানেই তাঁরা এবার উদ্যাপন করেছেন আনন্দের ঈদ।

সরেজমিনে উপজেলার এম আর খান আশ্রয়ণ প্রকল্প, বেগুনবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয়ণের ঘরে ঘরে সেমাই, পিঠাপুলি ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। ঘরে ঘরে বইছে ঈদের আনন্দ।

দুপুর ১টার দিকে এম আর খান চা বাগান-সংলগ্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঈদ উপহার (সেমাই, দুধ, চিনি, ডাল, চাল, তেল, নুডলস ইত্যাদি) নিয়ে ঈদ আনন্দে শামিল হতে আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ। সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সন্দ্বীপ তালুকদার, উপজেলা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাবেদ প্রমুখ। তাঁরা প্রতিটি ঘরে গিয়ে আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

শ্রীমঙ্গল উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হবে ৯৬০টি। এরই মধ্যে কাগজপত্র হস্তান্তর করা হয়েছে ৭৯৮টি পরিবারের কাছে। সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্প--এর প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যায় পর্যন্ত হস্তান্তর করা ৬৭৪টি ঘরে পরিবার নিয়ে উঠেছেন উপকারভোগীরা। জায়গা নির্বাচন, ঘর নির্মাণ উপকারভোগী নির্বাচনে সর্বোচ্চ যাচাই-বাছাই করায় এখানকার আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলো পেয়েছে নান্দনিকতার ছোঁয়া।

জাম্বুরাছড়া গ্রামের সঞ্জিতা দেববর্মা নামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আরেক নারী বলেন, বিয়ের কয়েক বছর পরই তাঁর স্বামী মারা যান। ওই সময় খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। একটা লেবুবাগানে শ্রমিকের কাজ করতেন। বাগানের ভেতরেই ঝুপড়িতে মায়ের সঙ্গে থাকতেন। ঝড়-বৃষ্টির রাতে খুব কষ্ট হতো। এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি গোছানো ঘর পেয়েছেন। এমন সুন্দর একটা ঘরের মালিক হবেন, কল্পনা করতে পারেননি।

মেয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে থাকেন উপজেলার এম আর খান এলাকার মায়া খাতুন। তিনি বলেন, ‘আগে আমার পুরিরে (মেয়ে) নিয়া একজনর বাড়িত এতিমোর মতো থাকতাম। দুই বছর আগে ইখানো প্রধানমন্ত্রীর ঘর পাইছি। অখন আর কেউর বাড়িত থাকা লাগে না। ঘরোর লগে সবজি লাগাই, গরু-ছাগল পালি। এখন অনেক ভালা আছি আমরা।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে মসজিদ থাকায় নামাজ পড়ার জন্য দূরে যেতে হয় না। কারণে খুশি উপজেলার মাজদিহি আশ্রয়ণ প্রকল্পের সমীর আলী। তিনি বলেন, আগে সরকারি খাস জমিত একটা ঘরো থাকতাম। আমরারে খাস জায়গা থাকি আনিয়া ইখানো ঘর বানাইয়া দিছে। ঘরোর মালিকানা দিছে। তয় ইখানো মানুষ বেশি পানির টেংকি (পানির ট্যাংক) কম। লাইন ধরিয়া পানি নেওয়া লাগে। আরও কয়েকটা টেংকি হইলে আমরার ভালা হইলো নে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় উপজেলার মহাজিরাবাদ, বেগুনবাড়ী, এম আর খান, জেরিন চা-বাগান, দিলবরনগর, জাম্বুরাছড়া, খলিলপুর, বিলাশের পাড়, মাইজদিহি, ডলুছড়া, উত্তর টিকরিয়া এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। আশ্রয়ণ- এর তৃতীয় পর্যায় পর্যন্ত ৬৫০টি ঘর চতুর্থ পর্যায়ের ২৪টি ঘরে উপকারভোগীরা উঠেছেন। শ্রীমঙ্গল উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সন্দ্বীপ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, চতুর্থ পর্যায়ের কিছু ঘর বুঝিয়ে দিতে একটু সময় লাগবে। বিদ্যুৎ পানির সংযোগ বাকি রয়েছে। আশা করা যায়, ঈদের পরপর সবাই আশ্রয়ণের ঘরে উঠতে পারবেন। আশ্রয়ণ--এর প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয় লাখ ৭১ হাজার টাকা। আশ্রয়ণ- এর চতুর্থ পর্যায়ের প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, শ্রীমঙ্গলের আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোর রাস্তাঘাটসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভালো। প্রতিটি ঘর তৈরির সময় আমি নিজেসহ অন্য কর্মকর্তারা তদারক করছি। এখন পর্যন্ত কোনো ঘরে সমস্যা পাওয়া যায়নি। আমরা চেষ্টা করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো সর্বোচ্চ ভালোভাবে নির্মাণ করার।