প্রকাশের তারিখ : ২০ মার্চ ২০২৩

আগের ত্যা ভালোই আছি। এই হাঁস-মুরগি পালতেছি। গতবার ১০ হাজার টাকা বেঁচছি। এই বছরও ৬ হাজার টাকার হাঁসমুরগি বেঁচছি। এহনো আমার কাছে ২০ হাজার টাকার হাঁসমুরগি আছে। স্বামীর রোজগার আর আমার এই আয় দিয়্যা এহন আমাগের ভালোই আয়-উন্নতি হইতেছে। সরকারের এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে আইস্যা এহন নিজেগের জীবনডারে গুছায় নিবার পারতেছি।’

 

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের 'স্বপ্ননগর' আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ছবেদা বেগম (২১) সাংবাদিকদের একথা বলেন। 

ছবেদা জানান, মাত্র একবছর আগেও তারা ছিলেন ভূমিহীন। মাথা গোঁজার কোন ঠাইও ছিলোনা। স্বামী রাসেল মোল্যা একজন ভাঙারি ব্যবসায়ী। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন রাস্তার পাশে ঘর তুলে। এখন নিজেদের একটা ঠিকানা হয়েছে। যেটি তাদের জীবনসংগ্রাম এগিয়ে নিতে জীয়নকাঁঠির মতো কাজ করেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহীত মুজিব শতবর্ষে এই আশ্রয়ণ প্রকল্প সমাজের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের হতদরিদ্রদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।তাদেরস্বাস্থ্য, গড়আয়ু, শিক্ষা, আয় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

ফরিদপুর জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় আশ্রয়ণ প্রকল্প এই স্বপ্ননগর। যেখানে প্রায় তিনশো ঘর তৈরি করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহিত আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় ভূুমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য। এই স্বপ্ননগরে ভূমিহীনদের জমিসহ ঘরের পাশাপাশি সেখানে স্থাপন করা হয়েছে একটি মসজিদ, জেলা প্রশাসক স্কুল নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও একটি মাছ বাজার। আলফাডাঙ্গার উপর দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীর ভাঙ্গনের কবলে নিঃস্ব পরিবারসহ ভূমিহীনদের আশ্রয় এই স্বপ্ননগর। 

সেখানে ঘর পেয়েছেন ৬৫ বছর বয়স্ক সচিন দাস (৬৫)। স্ত্রী সবিতা দাস (৫৬) ও তিনি দুজনে এখন বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি করছেন ধামা, কুলা, খলই, ডালা সহ গৃহস্থালী নানা কুটিরশিল্প সামগ্রী। সচিন বললেন, আগেও এসব হাতে তৈরি জিনিষপত্র বেঁচে দিন চলতো। কিন্তু নিজের কোন ঠিকানা না থাকায় কোন ভরসা ছিলো না। মাথা গোঁজার কোন ঠাঁইও ছিলো না । এখন নিজেরা এসব বিক্রি করে সংসার গোছানোর স্বপ্ন দেখতেছি। ৩ ছেলে নিয়ে খেয়েপড়ে বাইচ্যা আছি। বিসিক তাকে সহায়তা করলে তিনি আরো  এগিয়ে যেতে পারবেন বলে জানান।

ছবেদা বেগম এবং সচিন দাসদের মতো এমন অনেকেরই জীবন বদলে যাওয়ার গল্প তৈরি হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে। যাদের কিছুদিন আগেও কোন বসতবাড়ি ছিলনা, অন্যের বসতবাড়িতে বাস করত। যদিও বা কেউ পরের জমি বা সরকারি জমিতে ঘর করে থাকার সুযোগ পেয়েছিলো, তবে তাদের সে ঘরবাড়ির দিকে তাকালে ভেসে উঠত কবি জসীমউদদীন এর সেই আসমানীদের ভেন্নাপাতার ছাউনির চিত্র। বর্তমানে সেই ভেন্নাপাতার ছাউনির বদলে উপভোগীদের এখন আশ্রয় মিলিছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার আশ্রয়ণের ঘরে।

ফরিদপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে জেলার নগরকান্দা উপজেলাকে ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করার পর এবার জেলার আলফাডাঙ্গা ও সালথা এ দুটি উপজেলাকেও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হবে। ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সারাদেশের আরো অন্যান্য এলাকার সাথে এ দুটি উপজেলাকেও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করবেন।

জানা গেছে, সরকার ঘোষিত ‘মুর্জিব শতবর্ষে থাকবে না কেনো গৃহহীন’ কর্মসূচিতে ‘সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২’এর আওতায় ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় তিনটি ধাপে ৭৩৫টি ভূমিহীন পরিবারকে ২ শতাংশ জমিসহ ঘরে উপহার দেয়া হয়েছে। সালথা উপজেলায় ঘর পেয়েছে ৬৩৩টি ভূমিহীন পরিবার। জেলায় সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার দুইশোর বেশি ভূমিহীন পরিবার এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগী রয়েছেন। ইতোমধ্যে তারা তাদের ঘরগুলোতে কেউ কৃষি খামার, কেউবা হাঁসমুরগির খামার গড়ে তুলছে। ঘরের আঙিনায় লাগানো হয়েছে পুঁই, সিম সহ নানাপ্রকারের গাছপালা।

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, ফরিদপুরের আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিস্থিতি খুবই ভালো। আমাদের যেই কর্মপরিকল্পনা ছিলো সেটি খুব ভালোভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। আগামী ২২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ফরিদপুরে ৪৪৭টি ঘর উদ্বোধন করবেন। তিনি বলেন, আমাদের পরিকল্পনা ছিলো ৫ হাজার ৭২৭টি ঘর নির্মানের পরিকল্পনা ছিলো। এ পর্যন্ত ৫ হাজার ২০৩টি ঘর নির্মাণ করেছি। আর প্রায় ৫শ’ বাকি থাকে। আশা করছি জুনের আগেই বাকি ঘরগুলো নির্মাণ সম্পন্ন করতে পারবো।

জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, আমাদের সালথা এবং আলফাডাঙ্গা উপজেলা দুটি ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করা হচ্ছে। এখানকার জনপ্রতিনিধি, সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক সকলের সাথে বৈঠন করে নিশ্চিত হয়েছি এখানে আর কোন ভূমিহীন নেই। অনেকের গৃহ নেই কিন্তু জমি আছে। আমরা তাদের বিষয়টিও বিবেচনায় রেখেছি। তাদেরকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে গুচ্ছ গ্রাম একটি প্রকল্প চালু আছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা তাদের পূনর্বাসনের চেষ্টা করবো।

তিনি জানান, গত দেড় বছরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগীদের নিয়ে একটি শুমারি করেছি। তাতে দেখেছি, এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে উপকারভোগীদের মাসিক উপার্জন ছিলো গড়পরতায় ৬ হাজার টাকা। আশ্রয়ণ প্রকল্পে আসার পর তাদের উপার্জন ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকার মতো হয়েছে। এছাড়া জেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৯৭ পার্সেন্ট ঘরে মানুষ বসবাস করছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক জানান, যেই ৩ পার্সেন্ট ঘরে শুমারিতে খালি পাওয়া গেছে সেগুলো কাজের প্রয়োজনে মানুষ বাইরে রয়েছে দেখা গেছে। তারপরেও যদি কোন ঘর খালি থাকে তাহলে তাদের বরাদ্দ বাতিল করে নতুনদের দেয়া হবে। তাদের স্বাস্থ্য, গড় আয়ু, শিক্ষা, আয় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

আশ্রয়ণে থাকার আগে তাদের যে উপার্জন হতো, এখানে আশ্রয় পাওয়ার পরে আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ায় তাদের আয়বর্ধক পথ বেড়েছে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে উপার্জন বেড়েছে। তাদের স্বাস্থ্য সেবা বেড়েছে। তারা সন্তানদের শিক্ষাদিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পারছে। তাদের দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে জড়িতদের মতে, বিশ্বের অনেক দেশ যখন মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করার কথা ভাবতে পারেনা, সেখানে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার দুই শতাংশ জমি ও তার উপর একটি সেমি পাকাঘর পাচ্ছে। এই উদ্যোগ যেমন মানবিক তেমনি সংবিধানের  মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ। আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রয়প্রাপ্ত পরিবার অনিরাপদ জীবন-যাপন করত, ঝড়-বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় যখন আত্মমর্যাদা হারাতে বসেছিল; তখন এ প্রকল্প তাদের স্বপ্ন দেখায় উন্নত জীবনের। তারা উন্নয়নের মূলস্রোতে ফিরে মানসম্মত জীবন-যাপনের মাধ্যমে আত্মমর্যাদাশীল নাগরিকে পরিণত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।