
- বিভাগঃ ঢাকা
- জেলাঃ গোপালগঞ্জ
- উপজেলাঃ গোপালগঞ্জ সদর
- পৌরসভা/ইউনিয়নঃ লতিফপুর
গোপালগঞ্জ শহরের অদূরবর্তী মধুমতি নদীর তীরে ছোট্ট গ্রাম মানিকদাহ। ছায়া সুনিবিড় এই গ্রামে দরিদ্র এক দিনমজুর শহীদ বিশ্বাসের বসবাস। ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে ছয় সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে কোন রকমে দিনাতিপাত করছিলেন। তার তৃতীয় সন্তান জিয়াসমিন। অভাবের তাড়নায় ১৪ বছরের জিয়াসমিনের বিয়ে হয় জুয়েল খান নামের এক ফেরিওয়ালার সাথে। জুয়েল খানেরও নিজের কোন জায়গা জমি নেই। স্ত্রী জিয়াসমিনকে নিয়ে পাশের গাবতলা নামক জায়গায় একটি ঘর ভাড়া করে বসবাস করতে থাকে। দরিদ্র পিতার ঘরে অভাবের মধ্যে বড় হওয়া জিয়াসমিন সুখের প্রত্যাশায় শুরু করে জীবনের নতুন অধ্যায়। একটি সুখের নীড়, সুন্দর দাম্পত্য জীবন, পেট ভরে খাবার মাঝে মধ্যে একটি নতুন কাপড়, এই তার স্বপ্নের সীমানা। কিন্তুঅল্পদিনেই ভেঙ্গে যায় জিয়াসমিনের স্বপ্ন। স্বামীর সামান্য উপার্জনে সংসার চলেনা। টানাটানির সংসারে প্রায়ই ঝগড়া-ঝাটি লেগে থাকে। অন্যের ঘরে ভাড়া থাকায় প্রতিমাসে ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়। তার উপর রয়েছে পান থেকে চুন খসলে বাড়ি ছেড়ে দেয়ার নোটিশ। এভাবেই চলছিল। এর মাঝে একটি সন্তান আসে তাদের জীবনে। হঠাৎ স্বামীর আচরণ বদলাতে শুরু করে। একদিন জিয়াসমিন জানতে পারে তার স্বামী আরেকটি বিবাহ করেছে। স্বামী এখন প্রায় রাতেই বাড়ি ফেরেনা। সংসার খরচের টাকাও দেয়না বললেই চলে। সংসার চালানোর জন্য জিয়াসমিন একটি এনজিওর অধীন রাস্তা পরিস্কারের কাজ নেয়। নিজ উপার্জন আর স্বামীর দেয়া সামান্য টাকায় খুব কষ্টে, অভাবে আর দুঃখে কাটতে থাকে জিয়াসমিনের জীবন। কিছুদিন পর সে আরেকটি সন্তানের মা হয়। এখন তার সংসার অনেক বড়। যে নির্ভরতার আশা নিয়ে সে জীবন শুরু করেছিল, আজ তার জীবনে সেই নির্ভরতা বা নিশ্চয়তাটুকুই নেই। একটি সংসার তার ঠিকই হয়েছে, একজন স্বামীও আছে কিন্তু সকল দুশ্চিন্তা আর দায়িত্বের বোঝা যেন একা তার কাঁধে। সেদিন প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করতে গিয়ে জানতে পারে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন এবং গৃহহীনদের মাঝে জমি ও ঘর প্রদান করবেন। সে উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে তার সমস্যার কথা বলে। অফিস থেকে তার জন্যে একটি আবেদন করে দেয়। এর কিছুদিন পর পৌর ভূমি অফিস থেকে কয়েকজন লোক এসে তার সম্পর্কে খোজ খবর নেয় এবং তার কিছুদিন পরে সে জানতে পারে তার নামে মুজিববর্ষ উপলক্ষে নির্মিত মানিকদাহ আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর বরাদ্দ হয়েছে, সেই সাথে দুই শতাংশ জমি। জিয়াসমিন নিজের ঘরে ওঠে। সৌভাগ্যক্রমে তার বাবার গ্রামে তার শৈশবের নদী মধুমতির তীরে দুই শতাংশ জমিসহ একটি ঘর আজ তার নিজের নামে দলিল রেজিস্ট্রি করা একান্ত নিজের জমিতে নিজের ঘর। পেছনের সব কষ্টগুলো সে ভুলে যায়।
প্রধানমন্ত্রীর এই অসামান্য উপহার নিমিষেই তার মনের কষ্টগুলোকে যেন একটি সংগ্রামী শক্তিতে রূপান্তরিত করে। একটি এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে তার ঘরের সামনের বারান্দায় একটি ছোট্ট মুদি দোকান দেয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পে তার প্রতিবেশী বাসিন্দারা নিয়মিত তার দোকান থেকে কেনাকাটা করতে শুরু করেন। শহরের সাথে পাকা রাস্তার সহজ যোগাযোগ থাকায় দোকানের মালামাল কেনাকাটায়ও কোন অসুবিধা হয়না। জিয়াসমিনের সংসারে সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করে ।
সপ্তাহে ১১০০/- টাকার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার পরেও জিয়াসমিন তার সংসার খরচ চালাতে পারছে নির্বিঘ্নে । ছোট্ট মাথা গোঁজার ঠাইয়ে সরকার বিনা খরচায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে। এখন আর কেউ বাড়ি ফেরার নোটিশ দেয়না, ছেলে-মেয়েরা কান্নাকাটি করলে চোখ রাঙায় না। স্বামী জুয়েল খান নিয়মিত আসে। আসার সময় প্রায়ই বাজার করে নিয়ে আসে, বাচ্চাদের জন্য খেলনা কিনে দেয়, জিয়াসমিনের হাতে সংসার খরচের টাকাও দিতে চায়। স্বামী তার তাকে আগের চাইতে অনেক বেশী ভালবাসে। বাচ্চাদের ব্যাপারেও বাবা হিসেবে ইদানিং অনেক যতœশীল এবং দায়িত্ববান হয়েছে। কিছুদিন হলো জিয়াসমিন ঋণ নিয়ে একটি গাভী কিনেছে। স্বামী স্ত্রী মিলে ঘরের এক কোনে একটি ছোট্ট গোয়াল ঘর তৈরি করেছেন। তার পালে এখন দুটি রাজহাঁস এবং ছয়টি মুরগি আছে। ছেলে-মেয়েদের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিক্রিও করতে পারে। ঘরের কোনে কিভাবে যেন একটি কলা গাছ গজিয়েছিল। সেখানে কলা হয়। পাকা কলা কেটে সে তার বাচ্চাদের খেতে দেয় এবং নিজের দোকানে ঝুলিয়ে হালি হিসেবে বিক্রি করে। সে ভাবে, নিজের জায়গায় হওয়া গাছের ফল ছিড়ে খাওয়া; এও কি হতে পারতো আমার জীবনে! মাঝে মাঝে সত্যিই স্বপ্ন মনে হয়।
জিয়াসমিনের জীবনে এখন সুখ ফিরে এসেছে। তার ছিন্নমূল জীবনের অবসান হয়েছে। এক খ- জমি, একটি ঘর এখন তার শান্তির ঠিকানা। সে এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। সে তার স্বপ্নের সীমানা আজ স্পর্শ করেছে। তার নিজের একটি পরিবার আছে। পরিবারের সব কিছু এখন তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। স্বামী সন্তান নিয়ে তার সুখের জীবন। ভবিষ্যতে সে তার সন্তানদের শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। রাতে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে সে ভাবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহার, তার জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছে। তার জীবনে সুখ এনে দিয়েছে, যা সে তার বাবার সংসারে বা স্বামীর উপর নির্ভরশীল জীবনে পায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে নতুন জীবন দান করেছেন।